পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর। যেন কোন খেয়ালি খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর। খোকার চলে-যাওয়া পথের পানে জননির মতো চেয়ে আছে – খোকার খেলার পুতুল সামনে নিয়ে। এরই একটেরে চাঁদ-সড়ক। একটা গোপন ব্যথার মতো করে গাছ-পালার আড়াল টেনে রাখা। তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মুসলমান আর ‘ওমান কাত্লি’ (রোমান ক্যাথলিক) সম্প্রদায়ের দেশি কনভার্ট ক্রিশ্চানে মিলে গা-ঘেঁঘাঘেঁষি করে থাকে এই পাড়ায়। এরা যে খুব সদ্ভাবে বসবাস করে এমন নয়। হিন্দুও দু-চার ঘর আছে – চানাচুর ভাজায় ঝালছিটের মতো। তবে তাদেরও আভিজাত্য-গৌরব ওখানকার মুসলমান-ক্রিশ্চান – কারুর চাইতে কম নয়। একই-প্রভুর-পোষা বেড়াল আর কুকুর যেমন দায়ে পড়ে এ ওকে সহ্য করে – এরাও যেন তেমনই ।
বন্ধু আমার! পরমাত্মীয়! দুঃখ-সুখের সাথি! তোমার মাঝারে প্রভাত লভিল আমার তিমির রাতি। চাওয়ার অধিক পেয়েছি – বন্ধু আত্মীয় প্রিয়জন, বন্ধু পেয়েছি – পাইনি মানুষ, পাইনি দরাজ মন। চারিদিক হতে বর্ষেছে শিরে অবিশ্বাসের গ্লানি, হারায়েছি পথ – আঁধারে আসিয়া ধরিয়াছ তুমি পাণি। চোখের জলের হয়েছ দোসর, নিয়েছ হাসির ভাগ, আমার ধরায় রচেছে স্বর্গ তব রাঙা অনুরাগ। হাসির গঙ্গা বয়েছে তোমার অশ্রু-তুষার গলি, ফুলে ও ফসলে শ্যামল করেছে ব্যথার পাহাড়তলি! আপনারে ছাড়া হাসায়েছ সবে হে কবি, হে সুন্দর; হাসির ফেনায় শুনিয়াছি তব অশ্রুর মরমর! তোমার হাসির কাশ-কুসুমের পার্শ্বে বহে যে ধারা, সেই অশ্রুর অঞ্জলি দিনু, লহো এ ‘বাঁধন-হারা’।
বাঁশি বাজছে, আর এক বুক কান্না আমার গুমরে উঠছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হল তখন, যখন বৈশাখের গুমোটভরা উদাস-মদির সন্ধ্যায় বেদনাতুর পিলু-বারোঁয়া রাগিণীর ক্লান্ত কান্না হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরুচ্ছিল। আমাদের দুজনারই যে এক-বুক করে ব্যথা, তার অনেকটা প্রকাশ পাচ্ছিল ওই সরল-বাঁশের বাঁশির সুরে। উপুড়-হয়ে-পড়ে-থাকা সমস্ত স্তব্ধ ময়দানটার আশে-পাশে পথ হারিয়ে গিয়ে তারই উদাস প্রতিধ্বনি ঘুরে মরছিল! দুষ্ট দয়িতকে খুঁজে খুঁজে বেচারা কোকিল যখন হয়রান পেরেশান হয়ে গিয়েছে, আর অশান্ত অশ্রুগুলো আটকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় বারংবার চোখ দুটোকে ঘষে ঘষে কলিজার মতো রক্ত-লোহিত করে ফেলেছে, তখন তরুণী কোয়েলিটা তার প্রণয়ীকে এই ব্যথা দেওয়ায় বোধ হয় বাস্তবিকই ব্যথিত হয়ে উঠেছিল।